রিবাপবলিক গ্রন্থে আদর্শ রাষ্ট্র:
প্লেটো তাঁর বিখ্যাত ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে একটি
আদর্শ রাষ্ট্রের রূপ চিত্রিত করেছেন এবং এই আদর্শ রাষ্ট্রের অভিভাবকর শিক্ষাব্যবস্থা শৈশব থেকে কোন পথে পরিচালিত হবে তা সম্পর্কে বিবৃত দিয়েছেন।

অভিভাবকদের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে তিনি যে আলোচনা করেছেন তার থেকেই প্রধানত আমরা প্লেটোর শিক্ষা সম্পর্কীয় তত্ত্ব সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে থাকি।

প্লেটোর মতে শিক্ষা বলতে কি বুঝি?
প্লেটোর মতে, শিক্ষা অন্ধ চোখে দৃষ্টি নিয়ে আসা না, এ হল চক্ষুকে আলোকের দিকে চালিত করা। শিক্ষা হল, আত্মা স্বাভাবিকভাবে যে দৃষ্টিশক্তির অধিকারী, তাকে আলোকের দিকে চালিত করা। এই উপমার মাধ্যমে প্লেটো যে কথা বোঝাতে চেয়েছেন, যে জ্ঞানের অধিকারী নয় তার মধ্যে সেই জ্ঞান প্রবিষ্ট করনোকে শিক্ষা বলে অভিহিত করা যেতে পারে না। শিক্ষা হল আত্মার মধ্যে যে সব উৎকৃষ্ট গুণ প্রচ্ছন্ন হয়ে উঠেছে সেগুলোকে প্রকট করে তোলা এবং আত্মাকে যথাযথ বিষয়ের দিকে চালিত করে সেই উদ্দেশ্য সিদ্ধ করা। শিক্ষা হল শুধুমাত্র বুদ্ধিকে প্রদীপ্ত করা নয়, সমস্ত আত্মাকে যথাযথ পথে চালিত করা।

শিক্ষার ক্ষেত্রে পরিবেশ কতটা গুরুত্বপূর্ণ? প্লেটোর মতে, প্রতিটি ব্যক্তির আত্মা সত্য /ন্যায় শিক্ষা করার প্রয়োজনীয় শক্তির অধিকারী এবং সত্যকে প্রত্যক্ষ করার ইন্দ্রিয় তার রয়েছে। শিক্ষার জন্য যে বিষয়টির প্রয়োজন, তা হল আত্মার পক্ষে পরিবর্তনশীল আগতিক পরিবেশের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ না করে, পরমসত্তা বা কল্যান (Good)-কে উপলব্ধির জন্য সচেষ্ট হওয়া। শিক্ষার ক্ষেত্রে পরিবেশ যে কতখানি গুরুত্বপূ প্লেটো সেটি উপলদ্ধি করেছিলেন। তাই তাঁর মতে, শিক্ষার প্রধান সমস্যা হল আত্বাকে বা মানুষের মনকে যথাযথ পরিবেশে রাখা। সমস্ত শিক্ষা ব্যবস্থাটি হবে এমন, যাতে আত্মা যা হতে চায় তার দ্বারা তাকে পরিবেষ্টিত রাখা যায়। সোজা কথায়, শিক্ষা হল আত্মার জন্য সুস্থ পরিবেশ সৃষ্টি করা।

আত্মার পক্ষে প্রয়োজন মহৎ ব্যক্তি সম্পর্কে চিন্তা করা:
প্লেটোর মতে, মানুষের আত্মা বিশেষভাবে অনুকরণধর্মী। অপর ব্যক্তির কার্যকলাপ আমাদের কিভাবে প্রভাবিত করে তা থেকেই এই অনুকরণ প্রবণতার দৃষ্টান্ত আমরা লক্ষ করতে পারি। সেই কারণে প্রয়োজন আত্মার পক্ষে মহৎ ব্যক্তি সম্পর্কে চিন্তা করা এবং যে দেবতার মানুষ উপাসনা করে তাদের সম্পর্কে মহৎ ধারণা পোষণ করা।

আত্মার ওপর কলার ( Arts) প্রভাবও লক্ষণীয়, কেননা প্লেটোর মতে, সৌন্দর্যের ধ্যান করতে গিয়ে আত্মা সৌন্দর্যকে নিজের মধ্যে গ্রহণ করতে পারে। আত্মা বিজ্ঞান শিক্ষার মাধ্যমে তার পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যতা বিধান করে।

পরের প্রশ্ন হল, কোন বিষয়ের মাধ্যমে শিক্ষাকার্য সম্পন্ন হবে?

প্লেটোর মতে, তা হল দেশের প্রচলিত আদর্শ সাহিত্য, কলার (Art) প্রাথমিক জ্ঞান, গঠিত ও জ্যামিতির জ্ঞান। এ ছাড়াও রয়েছে শরীর চর্চা বা ব্যায়ামের (Gymnastics) প্রয়োজনীয়তা। প্লেটো মনে করতেন যে, প্রথম জীবনে, আত্মার মধ্যে প্রচ্ছন্ন সৎগুণগুলোকে প্রকট করে তোলার জন্য প্রয়োজন সাহিত্য, শিশুদের কাহিনী নিয়ে যার শুরু, তারপর কাব্য। দ্বিতীয় প্রয়োজন হল সঙ্গীত এবং তৃতীয় প্রয়োজন হল মৃন্ময়শিল্প, সূচিশিল্প, ভাস্কর্য প্রভৃতি কলার চর্চা। এই শিক্ষা আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত চলবে। তারপর ছাত্রকে সামরিক কাজের জন্য উপযুক্ত করে তুলতে বিশেষ ধরনের ব্যায়াম চর্চার প্রয়োজন। তারপর বিজ্ঞানের শিক্ষা, সর্বশেষে দর্শনের শিক্ষা।

প্লেটোর রিপাবলিকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ডকে পঞ্চম এবং সপ্তম খণ্ডের সঙ্গে একত্রে যুক্ত করে পাঠ করলে দেখা যাবে যে, শিক্ষার ক্রম (Order) সম্পর্কে তাঁর অভিমত আত্মার প্রকৃতি সম্পর্কীয় এক বিশেষ মতবাদের সঙ্গে যুক্ত। আত্মার বিকাশের মূলে রয়েছে শিক্ষার প্রভাব এবং এই শিক্ষা ভিন্ন ভিন্ন উপায়ের মাধ্যমে আত্মাকে প্রভাবিত করে থাকে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *